মাথিনের কূপ টেকনাফ ( Mathiner Kup teknaf )

মাথিনের কূপ টেকনাফ

মাথিনের কূপ টেকনাফকক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর কূলে টেকনাফ থানা চত্বরে অবস্থিত। এই জায়গাটি স্থানীয়ভাবে 'মাথিনের কূপ' নামে পরিচিত। 

১৮ শতকের শেষ দিকে টেকনাফ উপজেলায় পানির অভাব পূরণের জন্য মাত্র একটি সুপের পানি কূপ ছিলো।আর সেই কুপ ছিলো টেকনাফ থানার প্রাঙ্গনে। সেই কূপ থেকে রাখাইন তরুনীরা বিচিত্র সাজ সজ্জায় সজ্জিত হয়ে প্রতিদিন জল নিতে আসতো। 

মাথিনের কূপ টেকনাফ ঘিরে অমর প্রেম কাহিনীঃ

টেকনাফ থানায় কলকাতা থেকে বদলি হয়ে আসে নতুন পুলিশ কর্মকর্তা তরুন ও সুদর্শন ধীরাজ ভট্টাচার্য। থানার প্রাঙ্গণে সবার সাথে রাখাইন জমিদার কন্যা সুন্দরী ও সুনয়না মাথিন ও জল নিতে আসতো।

জমিদারের কন্যা মাথিন প্রতিদিন জল আনতে গিয়ে ঘটনাচক্রে পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এইভাবে বেশ কিছুদিন প্রেমের সম্পর্ক চলাকালীন শেষ পরিনতি হিসাবে তারা দুজনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। 

কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্যের বাবার অসুস্থতার খবর পায়।ধীরাজ এই খবর জানার পর মাথিনকে বলে, আমি কলকাতায় ফিরে যেতে চাই কিন্তু মাথিন ধীরাজকে যেতে বাধা দেয়। 

কারণ মাথিন মনে মনে ভাবছিলো ধীরাজ একবার কলকাতা গেলে আর ফিরে আসবে না। এর ভয়ে মাথিন ধীরাজকে কলকাতা যাইতে বাধা দেয়। কিন্তু কিছুদিন পরে ধীরাজ মাথিনকে না জানিয়ে গোপনে কলকাতায় চলে যান।এবং মাথিনের শংঙ্কা বাস্তবে রুপ চায়।ধীরে ধীরে তা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আরো পড়ুনঃ ইনানী রয়েল রিসোর্ট কক্সবাজার (inani royal resort)

যখন দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও ধীরাজ ফিরে এলোনা।মাথিন ধীরাজ এর জন্য প্রতিদিন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আর তার প্রেমের পরিক্ষা দিতে থাকে।ঠিক এমন অবস্থায় ভালবাসার প্রিয় মানুষটার চলে যাবার কষ্টে, অনাহারে থাকতে থাকতে নিজের জীবনকে চিরতরে বিসর্জন দিয়ে দিলেন রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিন।ধীরাজের এই ছলনা মাথিন কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন।

ধীরাজ ভট্টাচার্য ও জমিদার কন্যা মাছিনের প্রেমের নির্দশনটিকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সংরক্ষন করে মাথিনের কূপ (Mathiner Kup) নামকরণ করেন। জমিদার কন্যা মৃত্যুবরণ করার প্রায় ৮০ বছর পর ২০০৬ সালে টেকনাফ থানার কর্মকতা খালেদ হোসেন ও সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস রানা মাথিনের কূপ সংস্কার করেন। এই জায়গাটি কালের পরিক্রমায় মাথিনে্র প্রেমের নির্দেশন হিসাবে সর্বত্র পরিচয় লাভ করেন। 

মাথিনের কুপ টেকনাফ এর জনপ্রিয় হয়ে ওঠাঃ

এই এলাকার স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায় ১৯০৫ সালে ৫ নভেম্বর বিট্রিশ ইন্ডিয়ায় ইস্ট বেঙ্গলের যশোর জেলায় ধীরাজ ভট্রাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। ধীরাজ ভট্টাচার্য পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯২৩-১৯২৪ সালের দিকে কক্সবাজার জেলার টেকনাফে কর্মরত ছিলেন। 

পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে "যখন আমি পুলিশ ছিলাম" লাহারের ইউনিক পাবলিকেশন্স থেকে আন্ত জীবনীমূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। 

এই বইয়ে ধীরাজ ভট্টাচার্য মুলত মাথিনের প্রসঙ্গে লিখেন, এই গ্রন্থে মূলত মাথিন ও ধীরাজের প্রেমের কাহিনী ফুটে উঠে। সেই থেকে সবার ধীরে ধীরে টেকনাফে মাথিনের কূপটি নজরে আসতে শুরু করে। 

ঐতিহাসিক এই মাথিনের কূপের কাহিনী জানার পরে সন্ধানকারী আব্দুল কুদ্দুস রানা বাসের বেড়া দিয়ে মোড়ানো কূপটিতে ১৭৫ টাকা খরচ করে একটি টিনের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলেন।এখন এই মাথিনের কূপে প্রতি বছর ৬-৭ লাখ পর্যটক দেখতে আসেন।

উল্লেখ্য, ধীরাজ ভট্টাচার্য টেকনাফ ত্যাগের পর পুলিশের চাকরি ছেড়ে ১৯২৫ সালে তিনি সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। ধীরাজ ভট্টাচার্যের অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি "সতীলক্ষ্মী"। 

তারপর থেকে তার অভিনীত বেশ কয়েকটি ছবি মুক্তি পায়। যেমন ১৯৩০ সালে 'কাল পরিণয়' ও 'মৃণালিনী', ১৯২৯ সালে 'গিরিবালা',১৯৩২ সালে 'নৌকাডুবি' সহ ৫৫ টি ছবিতে অভিনয় করেছেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। 

১৯৫৮ সালে ধীরাজ ভট্টাচার্য শেষ ছবিটি মুক্তি পায়,ছবিটির নাম ছিলো 'নীলাকঙ্গা'। 

চলচ্চিত্রের অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি দুটি আন্তজীবনমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থগুলোর নামঃ " যখন পুলিশ ছিলাম"আরেকটি হলো "যখন নায়ক ছিলাম"।সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজের পক্ষে ওকালতি করে।আসল কথা ধীরাজ মাথিনের সাথে প্রতারণা করেন।

মাথিন তার প্রেমের স্বার্থকতার কথা জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।ধীরাজ সেখানে ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

মাথিনের কূপ টেকনাফ কিভাবে যাবেনঃ 

টেকনাফ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্বরে রয়েছে মাথিনের কূপ। ঢাকা ফকিরাপুল,গাবতলি, আব্দুল্লাহপুর,সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী,আরামবাগ, থেকে ঈগল, মডার্ন লাইন, সেন্টমার্টিন পরিবহন, গ্রীন লাইন, এস আলম ইত্যাদি বাস করে টেকনাফে যাওয়া যায়। বাসের ধরন ও মান অনুযায়ী জনপ্রতী টিকিটের ভাড়া ৯০০ থেকে ২,৫০০ টাকা।

ঢাকা থেকে সড়কপথ,রেলপথ কিংবা আকাশপথে কক্সবাজারে যাওয়া যায়। সেখান থেকে মাথিনের কুূপ দেখতে যেতে পারেন।  

ঢাকা থেকে কক্সবাজারগ্রামী বাসগুলো হলোঃ হানিফ এন্টারপ্রাইজ, গ্রীন লাইন, মডার্ন লাইন, শ্যামলী পরিবহন,  সৌদিয়া, সোহাগ পরিবহন, এস আলম মাসিডিজ বেঞ্চ, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 

শ্রেণীভেদে এই বাসগুলো ভাড়া ৯০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।কক্সবাজার থেকে লোকাল বাসে জীব অথবা সিএনজি করে যেতে পারেন টেকনাফে। 

মাথিনের কূপ টেকনাফ দেখতে গিয়ে কোথায় থাকবেনঃ 

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যায় তাই বেশিরভাগ ভ্রমণকারী কক্সবাজারে হোটেলে রাত্রিযাপন করেন। 

তবুও যদি কোনো সমস্যার কারণে টেকনাফে থেকে যেতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন কর্পোরেশনের একটি মোটেল যার নাম নেটং সেখানে যোগাযোগ করতে পারেন।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি ও ছিমছাম পাহাড়ী পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে।

মোটেলে থাকতে চাইলে রুম ভেদে ৬০০ থেকে ১,৫০০ টাকা খরচ হবে।এছাড়া টেকনাফে অনান্য সাধারণ মানের আবাসিক হোটেল ৫০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে থাকতে পারবেন। 

শেষকথা, কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে শুধু সাগর এর নীল জল আর আকাশ পাহাড়ের মিতালী নয়।আরো অনেক কিছু আছে যার মধ্যে মাথিনের কূপ টেকনাফ এক অমর প্রেম গাথা।দেখে আসুন আর ইতিহাসের প্রেমকাহিনীর অংশ হয়ে যান।

Post a Comment

0 Comments

হোটেল সী ওয়ার্ল্ড কক্সবাজার (Hotel Sea World Cox'sbazar)